সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আবারও রাজনীতি !!

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আবারও রাজনীতি !!



একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের ইঙ্গিতের পর বিএনপি যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আবার রাজনীতি শুরু করলো ---- 
বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন গত কাল রোববার বলেছেন, "আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরকারের গঠিত একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।সরকার সেখানকার তদন্ত সংস্থা নিয়োগ দিয়েছে।দলীয় আইনজীবীরা তাতে নিয়োগ পেয়েছেন।সরকার যা চাইবে,এই সংস্থা তাই করবে।" 
তিনি আরো বলেছেন "তাই এরকম বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীর সুষ্ঠু বিচার করা কঠিন হবে।সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে কি না,তা নিয়ে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে"।

যুদ্ধাপরাধী বিচার সম্পর্কে গত ৮ মে বেগম জিয়ার দেয়া বক্তব্য ও বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের এই বক্তব্য অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল।এর অন্যথা হলে বর্তমানে বেগম জিয়া ও তার বিএনপি -কে মানুষ নতুন বেগম জিয়ার বিএনপি আবিষ্কার করত।

আসুন যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে জামাত ও বিএনপি-র রাজনীতি পিছন থেকে দেখে আসি ----
বিএনপি- এর রাজনীতির একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে বলে অনেকের ধারণা।তা হচ্ছে বিএনপি কোন একটি বিষয় নিয়ে কী মন্তব্য করবেন বা কী বলবে সে সম্পর্কে আগাম ধারণা করা যায়।যেমন বিএনপি যখন বিরোধী দলে থাকেন তখন তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ অবশ্যই আওয়ামী লীগ।নব্বই পরবর্তীকালে তাই হয়ে আসছে। বিরোধীদলীয় বিএনপি -র সব বক্তব্যের সুর হচ্ছে আওয়ামী লীগের হাতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়,তারা দেশটাকে বিদেশীদের(পড়ুন ভারত) কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে,বাংলাদেশকে তারা একটা তাঁবেদার এবং অকার্যকর রাষ্ট্র তৈরি করে ফেলছে,নীল-নকশা বাস্তবায়নের জন্যই তাদের বিদেশী প্রভুরা ক্ষমতায় বসিয়েছে, দেশের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন,পবিত্র ইসলাম ধর্ম বিপন্ন,অওয়ামী লীগ বর্তমানে বাকশাল কায়েমে ব্যস্ত,তাদের আর সময় দেয়া যায় না ইত্যাদি।আর যখন বিএনপি সরকারে থাকেন তখন বিএনপি বাংলাদেশের একমাত্র ত্রাতার ভূমিকায় হয়,বিএনপি বলে ---বিএনপি হচ্ছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক,তাদের হাতে ইসলাম নিরাপদ,তাদের আমলেই উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশ ভাসে। 

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করার পর প্রথম যে নতুন রাজনৈতিক দলটি আত্মপ্রকাশ করে তা বিএনপি(পূর্বের নাম জাগদল)।সামরিক শাসক থাকা অবস্থায় জিয়ার যখন খায়েস হলো তিনি একটি রাজনৈতিক দল করবেন তখন তিনি জাগদলের ছাতার নিচে সব স্বাধীনতাবিরোধী ও অতিবামপন্থীদের একত্রিত করলেন।এর আগে বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলে প্রণিত দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এগার হাজার যুদ্ধাপরাধীদের তিনি কারামুক্ত করে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতকদের অবাধে বিচরণের ৰেত্র তৈরি করে দেন।একাত্তরে পাকিসত্মানী দখলদার বাহিনীর অন্যতম দোসর শাহ আজিজকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।চিহ্নিত ঘাতক আব্দুল আলীমের ঠাঁই হয় তার মন্ত্রিসভায়।একাত্তরের ঘাতক শিরোমণি ও পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেন জেনারল জিয়া।বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে জিয়া জামায়াতে ইসলামসহ অনান্য স্বাধীনতাবিরোধীদের বাংলাদেশে অবাধে রাজনীতি করার সুযোগও করে দেন।
জিয়ার মৃত্যুর পর তার আরব্ধ কাজ হাতে তুলে নেন বেগম জিয়া।তিনি গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বেগম জিয়া সরকার গঠন করেন।২০০১ সালে এসে বেগম জিয়া আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্যে নির্বাচনী জোট করেন এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তার মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দু'জন শীর্ষ নেতা নিজামী-মুজাহিদ,যারা একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী হিসাবে এখন কারাগারে ,তাদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেন।পরবর্তী পাঁচ বছরে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জামায়াত ঘরানার ব্যক্তিদের পদায়ন করেন।অন্য দিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির প্রাণশক্তি হচ্ছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী।সুতরাং এটি অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল বেগম জিয়া কিছু সময় মৌনব্রত পালন করলেও শেষে এক সময় তিনি ও তার দল নির্ধারিত অবস্থানেই ফিরে যাবে এবং গত ৮ মে বেগম জিয়ার দেয়া বক্তব্য ও আজ বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্য সম্প্রতি তাই হয়েছে। 

কি জামায়াতে ইসলামী,কি বিএনপি,- মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার নিয়ে অপপ্রচারে এসব দলের কোনওটিই পিছিয়ে নেই।তাই জামাত ও বিএনপি এখন তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এর বিরুদ্ধে।বাংলাদেশে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই যুদ্ধাপরাধী জামাতী দালালরা একটি ভুল করেছিল- বহু দলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠার নামে যখন তারা ঘরোয়া রাজনীতির টেবিলে ধর্মবাদী রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে দেনদরবার করছিল আর সামরিক জান্তা জিয়াকে দিয়ে নানা ফরমান জারি করাচ্ছিল,তখন দালাল আইনটি বাতিল করার ফরমান জারি করাতেই তারা আহ্লাদিত হয়ে উঠেছিল এবং এই আইনটিকে তখন তারা ‘আন্তর্জাতিক আইন’ হিসেবেই হয়তো বিবেচনা করেছিল (এখন অবশ্য তারা আর ‘আন্তর্জাতিক’ বলে মানতে রাজি নন,বরং আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার আবদার করে বেড়ানোই তাদের প্রধানতম মিশন এখন)।ফরমান জারি করে বাংলাদেশের তখন খোলনলচে পাল্টে দেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, কিন্তু এ আইনকে নিষিদ্ধ করার ফরমান জারির কথা তাদের চিন্তায়ও আসেনি।এখনও তারা বলছে বটে,এ আইন করা হয়েছিল পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্যে,তাদের নিয়ে এসে বিচার করেন- কিন্তু তারা নিজেরাও জানে,এই আইনের আওতায় তারাও পড়ে,কেননা তারা তো মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী হিসেবে কাজ করেনি,বরং পাকিস্তানীদের সহায়তাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করেছে।১৯৭১ সালে রাজাকারদের রেশন দেয়ার যে তালিকা পাওয়া গেছে,সেই তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নাম রয়েছে; আর শুধু নাম কেন, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে তাদের অনেক কুকীর্তিও রয়েছে।জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন হিসেবে এসব বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়নি,এসব বাহিনী গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী বাহিনী হিসেবে। সম্প্রতি তাই জামায়াতে ইসলামীর আক্রমণের মূল লক্ষ্য এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও মুক্তিযুদ্ধ ।

জামায়াতে ইসলামী এখন আর বলে না যে একাত্তরে ভুল করি নাই’ বরং বলে,একাত্তরে বাংলাদেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি,হয়েছে পাক-ভারত যুদ্ধ।আবার কখনো বলে আমরা এক পাকিস্তান চেয়েছিলাম,কিন্তু যুদ্ধাপরাধ করি নাই।’তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে,- কেননা তারা নিজেরা খুব ভালো করেই জানে,তারাই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের একমাত্র সমাবেশস্থল,একমাত্র মিলনমেলা।সবার মধ্যে নিজেদের নিয়ে খানিকটা আলোচনার পরিসরও খুজে পাওয়া এই গুলির কারন মনে হয়।জামায়াতে ইসলামীর এখন খুবই দুর্দিন।তারপরও তারা খোলা আকাশে তরবারি ঘোরাচ্ছে আর বলছে, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু বাতাসে উড়ে যাবে!’ঠিক এইভাবে তারা ১৯৭১-এও কথা বলেছিল।শূন্য কলস বাজে বেশি, জামায়াতে ইসলামীর বাজনাও তাই বেশি, সব সময়েই বেশি।আর সে কারণেই তারা হয়তো এখনও বুঝতে পারছে না,গত ২৬ জুলাই থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন এক পর্বে উন্নীত হয়েছে।যুদ্ধাপরাধের দায়ে এমন চারজন অভিযুক্তকে (পরে আরও একজনকে) কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, যাদের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে সংশয় বা সন্দেহ আছে এমন মানুষ বাংলাদেশে হাতে গোণা।মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষ যে তাদের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করছে,তার কারণ এই যুদ্ধাপরাধীরা একটি রাজনৈতিক দলের নেতা বনে বসে আছে এবং যুদ্ধাপরাধীরা তারা ইস্যুটির রাজনীতিকরণ ঘটাচ্ছে।

অন্যদিকে ১৯৭৩-এর অ্যাক্টকে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি অনেক দিন ধরে একই ভাবে প্রচার করছে,কারো কারো কাছে মনে হতে পারে,এ অ্যাক্ট বোধহয় ধরে-বেধে মানুষকে প্রহসনের বিচার করার আইন।চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে অনেকেরই মৃত্যুদণ্ডের বিধানটি নিয়ে আপত্তি রয়েছে,চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানটির বিরুদ্ধে প্রচারণার আড়ালে আসলে চেষ্টা চলছে ১৯৭৩-এর এই অ্যাক্টটি সম্পর্কেই জনমনে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার। 

এই বিএনপি-র কারনে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী দালালগুলো রাজনৈতিক দল করার অধিকার পেয়েছে এবং তাই গোপনীয়তারও কোনও বালাই নেই তাদের।গোলাম আযম,মতিউর রহমান নিজামী,আলী আহসান মুজাহিদ,কাদের মোল্লা আর দেলাওয়ার হোসেন সাঈয়েদী জাতীয় লোকরা তাদের যুদ্ধাপরাধী,স্বাধীনতাবিরোধী পরিচয় মুছে জামায়াত নেতা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে ।আর সে কারণেই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও যুদ্ধাপরাধীদের বাচানোর জন্যে তারা এখন রূপকথার রাক্ষসদের মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে,হিংস্র দাঁত দেখাচ্ছে,কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে দৌড়াতে লম্বা জিভ বের করে এদের অক্কা পেতে হবে, তাদের প্রাণভোমরাকে এবার গহীন পুকুরের তলদেশ থেকে তুলে আনা হয়েছে,কোনও দৈত্যই আর পারবে না সেটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।

৩৯ বছরে পরে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হয়েছে- কিন্তু এখনো ইস্যুটিকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি।তাই আমাদের শুনতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের অনেক কথা এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আমাদের আর কি-ইবা আছে?তুলনায় যুদ্ধাপরাধীদের সৌভাগ্য আকাশসমান।কেননা ইতিহাস তাদের জন্যে যে-শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছে,তার মুখোমুখি তাদের হতে হচ্ছে অনেক-অনেক পরে। 

আমি যে-টুকু বুঝি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী বিচারের সপক্ষে যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন,যে-সব ভুক্তভোগীরা ন্যায় বিচারের জন্যে অপেক্ষা করছেন তারা এটা বোঝেন যে,আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের এসব দিকগুলির ক্ষেত্রে পেশাদারি আইনজীবী ও ব্যারিস্টাররা ন্যায় বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে নিশ্চয়ই এসব নিয়ে অনেক ভেবেছেন। 

আমাদের বিশ্বাস যুদ্ধাপরাধীরা এবং তাদের পক্ষ হয়ে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতাকর্মী ও ব্যারিস্টার-আইনজীবীরা খুব অল্পদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবেন,একটি ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যে তারা যে-পথ বেছে নিয়েছিলেন,যে-ধারণাগুলি প্রচার করছিলেন,তা মোটেও সঠিক ছিল না।